মাণ্ডূক্য উপনিষদ

মাণ্ডূক্য উপনিষদ –

১) ওমিত্যেতদক্ষরমিদং সর্বং তস্যোপব্যাখ্যানং ভূতং ভবদ্‌ ভবিষ্যদিতি সর্বমোঙ্কার এব।য়চ্চান্যত্‌ ত্রিকালাতীতং তদপ্যোঙ্কার এব ॥

অর্থ:- ‘ওম্‌’ ব্রহ্মের প্রতীক, কার্য ও কারণ উভয়ই ব্রহ্ম। এই দৃশ্যমান জগৎও হচ্ছে ওম্‌। স্পষ্ট করে বলতে গেলে, যা কিছু অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ এই সবই ওঁকার। এই ত্রিকালের অতীতও যদি আর কিছু থাকে তবে তাও ওঁকার।

২) সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম অয়মাত্মা ব্রহ্ম সোऽয়মাত্মা চতুষ্পাৎ ॥

অর্থ:- সমগ্র জগৎই ব্রহ্ম। এই জীবাত্মাও ব্রহ্ম। আপাতদৃষ্টিতে এই আত্মার চারটি অবস্থা।

৩) জাগরিতস্থানো বহিঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ স্থূলভুগ্ বৈশ্বানরঃ প্রথমঃ পাদঃ ॥

অর্থ:- জাগ্রত অবস্থায় আমরা বাইরের জগৎ সম্পর্কে সচেতন এবং ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমেই আমরা এই জগৎকে উপলব্ধি করি। যাঁর সাতটি অঙ্গ এবং উনিশটি উপলব্ধির দ্বারা জীব হিসাবে তিনিই এই স্থূলদেহ ভোগ করেন। এটিই আত্মার প্রথম প্রকাশ।

৪) স্বপ্নস্থানোऽন্তঃপ্রজ্ঞঃ সপ্তাঙ্গ একোনবিংশতিমুখঃ প্রবিবিক্তভুক্ তৈজসো দ্বিতীয়ঃ পাদঃ ॥

অর্থ:- আমরা যখন স্বপ্ন দেখি তখন আমরা যা কিছু করি সেসবের অস্তিত্ব আমাদের মনে। স্বপ্ন বাহ্যবিষয়-বিহীন। এটা পুরোপুরি মনের ব্যাপার। স্বপ্ন হচ্ছে জাগ্রত অবস্থায় আমাদের বাসনা ও পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার ফলস্বরূপ। জাগ্রত অবস্থার মতো স্বপ্নবস্থাতেও আমাদের সাতটি অঙ্গ ও উনিশটি ইন্দ্রিয় অটুট থাকে, কিন্তু তখন আমরা যা কিছু কাজ করি মনের দ্বারা। এ অবস্থায় বাইরের জগতের সাথে কোন সম্পর্ক থাকে না। এই মানস অভিজ্ঞতার অধিপতি হল (ব্রহ্মের) দ্বিতীয় অবস্থা।

৫) য়ত্র সুপ্তো ন কঞ্চন কামং কাময়তে ন কঞ্চন স্বপ্নং পশ্যতি তৎ সুষুপ্তম্‌।
সুষুপ্তস্থান একীভূতঃ প্রজ্ঞানঘন এবানন্দময়ো হ্যানন্দভুক্‌ চেতোমুখঃ প্রাজ্ঞস্তৃতীয়ঃ পাদঃ ॥

অর্থ:- যখন তুমি গভীর নিদ্রায় মগ্ন থাক তখন তোমার মনে কোন কামনা-বাসনা থাকে না এবং তখন তুমি স্বপ্নও দেখ না; মন নিষ্ক্রিয় থাকে। একেই বলে সুষুপ্তি। জাগ্রত অবস্থায় বা স্বপ্নাবস্থায় তুমি বস্তু সম্পর্কে সচেতন। কিন্তু সুষুপ্তি অবস্থায় কোন বিষয় বা কোন দ্বৈত দৃষ্টি থাকে না। তখন শুধুই এক দেখা যায়। কিন্তু এই অবস্থায় বেশিক্ষণ থাকা যায় না। এ যেন সেই লক্ষ্যে পৌঁছে যাওয়া, যেখান থেকে আবার স্বপ্ন বা জাগ্রত অবস্থায় তোমাকে ফিরে আসতেই হবে। এটাই প্রাজ্ঞ—আত্মার তৃতীয় অবস্থা।

৬) এষ সর্বেশ্বরঃ এষ সর্বজ্ঞ এষোऽন্তর্যাম্যেষ য়োনিঃ সর্বস্য প্রভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাম্‌ ॥

অর্থ:- এই প্রজ্ঞা সকল বস্তুর অধীশ্বর। ইনি সর্বজ্ঞ, ইনিই অন্তর্যামী। সকল বস্তু এঁর থেকে উৎপন্ন হয়ে এঁতেই লীন হয়। ইনিই সবকিছুর কারণ।

৭) নান্তঃপ্রজ্ঞং ন বহিষ্প্রজ্ঞং নোভয়তঃপ্রজ্ঞং ন প্রজ্ঞানঘনং ন প্রজ্ঞং নাপ্রজ্ঞম্‌।
অদৃষ্টমব্যবহার্যমগ্রাহ্যমলক্ষণমচিন্ত্যমব্যপদেশ্যমেকাত্মপ্রত্যয়সারং প্রপঞ্চোপশমং শান্তং শিবমদ্বৈতং চতুর্থং মন্যন্তে স আত্মা স বিজ্ঞেয়ঃ ॥

অর্থ:- অন্তরস্থ ঘটনা সম্পর্কে তুরীয় সচেতন নন (এর থেকে বোঝা যায় তুরীয় তৈজস নন), বাইরের ঘটনা সম্পর্কেও ইনি সচেতন নন (অর্থাৎ তুরীয় বিশ্ব নন)। ইনি জাগ্রত ও স্বপ্নবস্থার মধ্যবর্তী কোন কিছু সম্পর্কেও সচেতন নন। (সুষুপ্তি অবস্থার প্রাজ্ঞও নন। ইনি সর্বজ্ঞও নন, অচৈতন্য নন। ইনি অদৃশ্য—লৌকিক ব্যবহারের অতীত, কর্মেন্দ্রিয় ও জ্ঞানেন্দ্রিয়—এই দুয়েরই ঊর্ধ্বে, মনের অগোচর, এবং কোন শব্দ দ্বারা ইনি নির্দেশিত নন। এই অবস্থায় থাকে শুধু আত্মার চৈতন্য এবং এখানে জগতের কোনও অস্তিত্ব নেই। এখানে শান্তি ও কল্যাণের মূর্ত প্রকাশ, এই চৈতন্য এক ও অদ্বিতীয়। এই চতুর্থ অবস্থাই তুরীয়। প্রাজ্ঞগণ একেই আত্মা বলেন। এই আত্মাকে উপলব্ধি করতে হবে।

৮) সোऽয়মাত্মাধ্যক্ষরমোঙ্কারোऽধিমাত্রং পাদা মাত্রা মাত্রাশ্চ পাদা অকার উকারো মকার ইতি ॥

অর্থ:- ওঁকারের বর্ণমালারূপে (অর্থাৎ অ, উ, ম) এখানেও সেই একই পরমাত্মা। আত্মার পাদসমূহই ওঁকারের মাত্রা। আবার ওঁকারের মাত্রাসমূহই আত্মার পাদ। অকার, উকার, মকার এই তিনটি ওঁকারের মাত্রা।

৯) জাগরিতস্থানো বৈশ্বানরোऽকারঃ প্রথমা মাত্রা।
আপ্তেরাদিমত্বাদ্ বা আপ্নোতি হ বৈ সর্বান্‌ কামানাদিশ্চ ভবতি য় এবং বেদ ॥

অর্থ:- জাগ্রত অবস্থায় বৈশ্বানররূপী পরমাত্মা ‘অ’ এই বর্ণের দ্বারা চিহ্নিত। বৈশ্বানর এবং ‘অ’ উভয়ই সর্বব্যাপী। যিনি একথা নিশ্চিতভাবে জানেন তাঁর সকল কামনা-বাসনা পূর্ণ হয়ে গেছে। তিনি সকলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

১০) স্বপ্নস্থানস্তৈজস উকারো দ্বিতীয়া মাত্রা উৎকর্ষাদুভয়ত্বাদ্ বা উৎকর্ষতি হ বৈ জ্ঞানসন্ততিং সমানশ্চ ভবতি নাস্যাব্রহ্মবিৎ কুলে ভবতি য় এবং বেদ ॥

অর্থ:- স্বপ্নাবস্থায় আত্মার তথা তৈজসের অবস্থান ‘অউম’-এর উ-এর তুল্য। কারণ উভয়ই মধ্যবর্তীস্থান অধিকার করে আছেন এবং উভয়ই সমান গুরুত্বপূর্ণ। যিনি এই দুই-এর অভিন্নতা জানেন তাঁর বোঝবার ক্ষমতা সকলের চেয়ে বেশি। এবং তিনি সাধু ব্যক্তিতে পরিণত হন। তাঁর পরিবারের সকলেই ব্রহ্মজ্ঞানী।

১১) সুষুপ্তস্থানঃ প্রাজ্ঞো মকারস্তৃতীয়া মাত্রা মিতেরপীতের্বা মিনোতি হ বা ইদং সর্বমপীতিশ্চ ভবতি য় এবং বেদ ॥

অর্থ:- সুষুপ্তি অবস্থার আত্মা তথা প্রাজ্ঞকে ‘অউম’-এর তৃতীয় অক্ষর ‘ম’-এর দ্বারা চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে অ এবং উ-এর সাথে যথাক্রমে বিশ্ব এবং তৈজসের সমাপ্তি ঘটে সেখানেই প্রাজ্ঞ এবং ম উভয়েরই অবস্থান। প্রাজ্ঞ এবং ম হল একত্বে বিলীন হয়ে যাওয়ার সিংহদ্বার। যিনি একথা জানেন তিনি এ জগৎকে জানেন, এবং জগতের বিশ্রামস্থল হয়ে ওঠেন।

১২) অমাত্রশ্চতুর্থোऽব্যবহার্যঃ প্রপঞ্চোপশমঃ শিবোऽদ্বৈত এবমোঙ্কার আত্মৈব সংবিশত্যাত্মনাত্মানং য় এবং বেদ য় এবং বেদ ॥

অর্থ:- (যেমন আগে বলা হয়েছে), ‘ওম্‌’-এর চতুর্থ অবস্থা হচ্ছে পরমাত্মা। এই আত্মা অনন্ত, বাক্যমনাতীত, অদ্বয় এবং শিবস্বরূপ। দৃশ্যমান জগৎ এঁরই মধ্যে রয়েছে। প্রজ্ঞাবান ব্যক্তিরা বলেন, জীবাত্মাই হলেন পরমাত্মা। যিনি এই তথ্য জানেন তিনি ব্রহ্মে লীন হয়ে যান। (তিনি নিজেকে আর কখনো জীবাত্মা বলে মনে করেন না।)

Scroll to Top